১৯৪৮ থেকে ২০২১ সাল। এই ৭৩ বছরে ফিলিস্তিনিরা যত কোণঠাসা হয়েছে, নিজ ভূমি-ভিটা থেকে বিতাড়িত হয়েছে এবং বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে, ইসরায়েলের শৌর্যবীর্য তত বেড়েছে। আজ গাজা ও পশ্চিম তীর নামের বিচ্ছিন্ন দুটি ভূখণ্ডে কোনোমতে টিকে আছে একদল ফিলিস্তিনি, বাকিদের বেছে নিতে হয়েছে আশপাশের দেশগুলোতে শরণার্থীর জীবন—এর বিপরীতে ফিলিস্তিনি ভূমি গ্রাস করে ইসরায়েল যেমন আয়তনে স্ফীত হয়েছে, তেমনি বিশ্বের অন্যতম সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্রেও পরিণত। অথচ জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুসারে ফিলিস্তিনেরও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই কথা কি বিশ্বের মনে আছে?
প্রতিবার ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের চালানো আগ্রাসনের সময় অবশ্য প্রশ্নটি সামনে আসে। নিষ্পাপ শিশু, ঘরকন্না করা সাধারণ নারী ও নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর মিছিল দেখে বিশ্ববিবেক কিছুটা নড়েচড়ে ওঠে! ব্যস, এতটুকুই। এরপর আবার হারিয়ে যায় ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবি, আত্মিক চাওয়া—স্বাধীনতার প্রশ্নটি। চলমান ইসরায়েলি বাহিনীর লাগাতার হামলায় এখন পর্যন্ত ৪১ শিশুসহ দেড় শতাধিক ফিলিস্তিনির প্রাণহানিতে প্রশ্নটি আবার আলোচনায়। এবং যথারীতি তা হারিয়ে যেতেও হয়তো সময় নেবে না। কেননা এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে, আত্মরক্ষার অধিকার ইসরায়েলের আছে। অতএব, যত দোষ নন্দ ঘোষ ফিলিস্তিনের!
অথচ ইসরায়েল এবার শুধু গাজার বেসামরিক স্থাপনাকেই লক্ষ্যবস্তু করেনি, আন্তর্জাতিক একাধিক গণমাধ্যমের একটি ভবনও গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ‘হামাসের সামরিক সম্পদ’ ভবনটিতে আছে, এমন দাবি করে হামলা চালানোর আগে মাত্র এক ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছিল। অতিরিক্ত ১০ মিনিট চেয়ে ইসরায়েলি এক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে নাকি বারবার অনুরোধ করেছিলেন ভবনমালিক, কর্ণপাত করা হয়নি। এপি, আলজাজিরাসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের কার্যালয়, বেসরকারি অফিস ও আবাসিক ফ্ল্যাট থাকা ‘জালা টাওয়ার’ নামের ভবনটি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় হোয়াইট হাউসের প্রেসসচিব বলেছেন, সাংবাদিক ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ইসরায়েলকে বলা হয়েছে।
গাজার নেতৃত্বে থাকা তথাকথিত সন্ত্রাসীগোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে গণমাধ্যমের কার্যালয়ে হামলা বৈধতা পেতে পারে কি না—এমন প্রশ্নও যখন জোরালোভাবে ওঠে না, তখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধের সিদ্ধান্তে অনড় থাকবেন, সেটাই স্বাভাবিক। এ কারণে হেস্তনেস্ত না হওয়া পর্যন্ত হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে বলে জোর গলায় ঘোষণা করতে পারেন তিনি।
গত সোমবার থেকে চলমান এ সংঘাতে জাতিসংঘসহ বেশ কয়েকটি দেশ উদ্বেগ জানিয়েছে। অস্ত্রবিরতির আহ্বান তাদের সবার। গতকাল রবিবার এ নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের নিন্দা-ধিক্কারে রাজপথে নেমেছে বিবেকবান মানুুষ। অবশ্য এসবে এতটুকু হেলদোল নেই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর। তাঁর সাফ কথা, ‘আমরা কোনো অপরাধ করিনি। যারা আমাদের আক্রমণ করছে, যাবতীয় দায় তাদের।’ সুতরাং ঈদের দিনও গাজায় হামলা চালিয়ে বেসামরিক মানুষের প্রাণহানিকে হামাসকে জব্দ করার অংশ বলেই মনে করে।
নেতানিয়াহুর দাবি, ‘ইচ্ছাকৃত সাধারণ নাগরিকদের আমরা নিশানা করছি না। নিরীহ নাগরিকদের এড়িয়ে হামাসের মতো সন্ত্রাসীদের ওপরই সরাসরি হামলা করছি।’
বলাই বাহুল্য, কোনো বারই সংঘর্ষে ইসরায়েলের গায়ে সেভাবে আঁচ লাগে না। বিপরীতে শয়ে শয়ে, এমনকি হাজার হাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনির হতাহত হওয়ার সাক্ষী বিশ্ব। এবারও হামাসের রকেট হামলায় ইসরায়েলি প্রাণহানির সংখ্যা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কেন?
রকেট হামলা ঠেকানোর জন্য সামরিক শক্তিধর ইসরায়েলের হাতে রয়েছে ‘আয়রন ডোম’। অত্যাধুনিক এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিশেষভাবে স্বল্প পাল্লার হুমকির বিরুদ্ধে জবরদস্ত কার্যকর। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরায়েলের রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমস ও ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের তৈরি আয়রন ডোম নাকি হামাসের ছোড়া ৯০ শতাংশ রকেটই মাটিতে পড়ার আগেই আকাশে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এমন প্রতিরক্ষাব্যবস্থাসহ বিশ্বের অন্যতম সশস্ত্র ও শক্তিধর ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের গণহারে মৃত্যু তাই ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এ অবস্থা আর কত দিন?
গোড়ার কথা
১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে একটি ইহুদি, অন্যটি আরব রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। তবে অন্যায্য ও অসম, এই যুক্তিতে এর বিরোধিতা করে আরবরা। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হলে প্রতিবেশী চার আরব দেশ—মিসর, সিরিয়া, জর্ডান ও ইরাক একযোগে ইসরায়েলকে হামলা করে। দুঃখজনকভাবে সেই যুদ্ধে পরাজিত হয় আরবরা। জাতিসংঘ পরিকল্পনায় বরাদ্দ ফিলিস্তিনের ৫৬ শতাংশ ভূখণ্ডের ৭৭ শতাংশেই দখল কায়েম করে ইসরায়েল। এর পরও এক চিলতে যে ভূখণ্ড পড়ে থাকে, সেখানেও স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল। কিন্তু সে পথে না হেঁটে তা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয় মিসর ও জর্ডান। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম চলে যায় জর্ডানের হাতে, আর গাজার দখল নেয় মিসর। এর পর থেকে শুধু ভূমি হারিয়ে নয়, প্রাণ দিয়েও ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করতে হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের।
১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা—পিএলওর মধ্যে চুক্তি হয়। সেই চুক্তির ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে পশ্চিম তীর ও গাজায় নামমাত্র ফিলিস্তিনি স্বায়ত্তশাসন কায়েম হয়। তত দিনে ওই অঞ্চলের বড় অংশই চলে গেছে ইসরায়েলের অবৈধ বসতির কবলে, সামরিক নিয়ন্ত্রণে। অবস্থা এমন যে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে ইসরায়েলি বাহিনীর অনুমতি নিতে হয় ফিলিস্তিনিদের।
কিন্তু ২০০৬ সালের নির্বাচনের পর ফিলিস্তিনি সেই প্রশাসনেও ফাটল ধরে। পশ্চিম তীর যায় ফাতাহর নিয়ন্ত্রণে, হামাস পেল গাজার নিয়ন্ত্রণ। সেই থেকে দুই নেতৃত্বের সম্পর্ক সাপে-নেউলে। ফাতাহ ক্ষমতায় থাকতে নতজানু পন্থা বেছে নিয়েছে, এ অভিযোগ হামাসের। বিপরীতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে হামাসের কর্মকাণ্ডে অখুশি ফাতাহ। এই বিভেদে সবচেয়ে লাভবান ইসরায়েল।
অন্যদিকে ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে না ‘সন্ত্রাসবাদী’ হামাস, সুতরাং ইসরায়েলসহ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন দলটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। সুতরাং সন্ত্রাসী দল হামাসকে জব্দ করতে বারংবার গাজায় চালানো ইসরায়েলের আক্রমণ বিশ্বনেতৃত্বের চোখে নৈতিকভাবে ‘বৈধতা’ পেয়ে যায়। যার সর্বশেষ প্রতিধ্বনি শোনা গেল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গলায়। তিনি ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের কথা জানিয়ে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে বললেন রকেট হামলা বন্ধ করতে। অথচ হামলা চালাচ্ছে হামাস।
গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাস ইসরায়েলসহ পশ্চিমাদের চোখে সন্ত্রাসী। সুতরাং তারা সন্ত্রাসীর সঙ্গে আলাপে রাজি নয়। ফাতাহ ও হামাসেরও পরস্পর মুখ দেখাদেখি বন্ধ। এই গ্যাঁড়াকলে পড়ে প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের।
এক দশক আগেও অধিকৃত পশ্চিম তীরের এক চিলতে জমিও যদি অধিগ্রহণের ঘোষণা দিত ইসরায়েল, আরব বিশ্বের ২২টি দেশেই একযোগে গলা চড়াত প্রতিবাদে। অথচ গত বছরের জুনে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জর্দান উপত্যকার বিশাল একটি অংশকে ইসরায়েলের অংশ বলে ঘোষণা দিলেন, আরব দুনিয়ায় কোনো উচ্চবাচ্য শোনা গেল না। এর দুই মাস না পেরোতেই দুটি আরব দেশ—বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ইসরায়েলের স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
অথচ প্রয়াত সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহর উদ্যোগে ২০০২ সালে ২২টি আরব দেশ একযোগে ঘোষণা দেয়, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখল করা ফিলিস্তিনি জমির দখল ছাড়াসহ পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী মেনে ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে না দেওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না। এর পরও দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের লড়াই-সংগ্রাম-দুর্দশার দিক থেকে আরব বিশ্বের অনেক দেশের নজর ক্রমে সরে যাচ্ছে।
আরব বসন্তের ধাক্কা, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন ও ইরাকে দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধ, আইএসের উপস্থিতি-হুমকি, তেলের দামে অধোগতি ইত্যাদিসহ অভ্যন্তরীণ নানা ইস্যুতে আরব দেশগুলোর সরকার অনেকটাই ব্যতিব্যস্ত। সেই সঙ্গে শিয়া ইরান নিয়ে এসব সুন্নিপ্রধান দেশের জুজুর ভয় তো আছেই।
সৌদি আরবসহ আরো কিছু আরব দেশের ইরানভীতি এতটাই প্রবল যে ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে তারা ‘রক্ষাকবচ’ হিসেবে দেখছে। সৌদি আরব যে নিজেই ‘আরব ইনিশিয়েটিভ’কে দুর্বল করে দিতে চায়, তার প্রথম ইঙ্গিত মেলে ২০১৮ সালে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের যুক্তরাষ্ট্র সফরে। তিনি ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের সমালোচনা করে বলেন, দাবিদাওয়া নিয়ে তাদের নমনীয় হওয়া দরকার। ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান সৌদি আরব চায়, কিন্তু ইরানের মোকাবেলা এখন তাদের ‘অগ্রাধিকারে’।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যনীতি এবং মুসলিম দুনিয়ার নেতৃত্ব নিয়ে টানাপড়েনকে কেন্দ্র করে আরব দেশগুলো বিভাজিত, যা ইসরায়েলকে উদ্দেশ্য হাসিলে প্রভূত সুবিধা করে দিয়েছে।